দেহের স্থূলতা সার্বজনীন রোগের বোঝা (Global Burden of Disease) বা ঝুঁকি হিসেবে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ক্ষীণকায় ব্যক্তি মোটা হচ্ছেন আর মোটা ব্যক্তি আরও স্থূলতায় ভুগছেন।
দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ১ কেজি করে দৈহিক ওজন বৃদ্ধি করছেন।
বর্তমানের এই ঘটনাপ্রবাহ মানুষকে স্থূলতা-বান্ধব অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে যেখানে মানুষ কায়িক পরিশ্রম বিমুখ হয়ে আয়েশী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে এবং রুচিবোধের পরিবর্তন হওয়াতে অধিক খাবার গ্রহণ করছে।
এতে দেখা যাচ্ছে সস্তা ও চটকদার বিজ্ঞাপন সর্বস্ব পুষ্টিবিহীন অধিক-শক্তি সম্পন্ন খাবার গ্রহণ এবং শ্রমবিমুখ আয়েশী যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা ও ব্যবহার (লিফট, রিমোট কন্ট্রোল, যানবাহন) দৈহিক স্থূলতাজনিত রোগ সৃষ্টিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে, যেমন –
১) পুষ্টি বিহীন অধিক শক্তিসম্পন্ন খাবার গ্রহণ –
★ অতিরিক্ত ভোজন
★ নিয়মিত খাবার বাদে ফাস্ট ফুডে অভ্যস্ত হওয়া
★ বাজে তেল ও অধিক শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়া
★ ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক সচ্ছলতা
২) কম শক্তি ক্ষয় –
★ ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি
★ স্কুল কিংবা কর্মস্থলে হেঁটে যেতে অনীহা
★ অটোমেশন বা সর্বক্ষেত্রে মেশিনের ব্যবহার
★ কায়িক পরিশ্রম বিমুখ হওয়া
★ স্কুলে খেলাধুলার চর্চা কমে যাওয়া
★ কম্পিউটার গেমস ও টিভি দেখায় অধিক সময় ব্যয় করা
★ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যাপক ব্যবহার।
এতে করে মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ স্থূলাকৃতি ধারণ করছে, মেটাবোলিক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়ে দেহের ভেতর ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে… ফলশ্রুতিতে ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির আধিক্য, উচ্চ রক্তচাপ, ফ্যাটি লিভার, স্ট্রোকের ঝুঁকি, হার্ট এট্যাকের ঝুঁকি, হাঁটু ব্যথা ইত্যাদি জটিল থেকে জটিলতর রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্থূলতাকে তাই বর্তমানে মহামারী হিসেবে দেখা হচ্ছে যা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ দৈহিক স্থূলতায় ভুগছেন যাদের BMI > 30 kg/m2। এদের মধ্যে অনেকেই দৈহিক স্থূলতাজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন এবং অনেকেই স্থূলতাজনিত জটিলতার জন্য চিকিৎসা নিচ্ছেন।
দৈহিক স্থূলতা জনিত জটিলতা সমূহ হলো –
(১) মনো-দৈহিক
★ ইটিং ডিজঅর্ডার বা অধিক খাবার গ্রহণ
★ পুওর সেল্ফ এস্টিম বা নিজের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ
★ বডি ইমেজ ডিজঅর্ডার বা দেহের আকার আকৃতি নিয়ে সংকীর্ণমনা হওয়া
★ সোশাল আইসোলেশন এন্ড স্টিগম্যাটাইজেশন বা সামাজিক ভাবে একঘরে হওয়া এবং বিশেষ ভাবে চিহ্নিত হওয়া
★ ডিপ্রেশন বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়া
(২) নিউরোলজিকাল বা স্নায়ু সম্পর্কিত
★ ইডিওপ্যাথিক ইন্ট্রাক্রেনিয়াল হাইপারটেনশন বা মস্তিষ্কের ভিতরের চাপ বৃদ্ধি
(৩) হৃদযন্ত্র সম্পর্কিত –
★ হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ
★ ডিসলিপিডেমিয়া বা রক্তে চর্বির আধিক্য
★ রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি
★ দীর্ঘ মেয়াদি প্রদাহ
★ এনডোথেলিয়াল ডিসফাংশন বা রক্ত নালীর নিচের দিকে প্রদাহ
(৩) ফুসফুস সম্পর্কিত –
★ শারীরিক কসরত অসহনশীলতা
★ অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বা রাতে ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া
★ অ্যাজমা
(৪) পরিপাকতন্ত্র সম্পর্কিত –
★ পিত্ত থলিতে পাথর
★ GERD বা বুক জ্বালা পোড়া
★ NAFLD বা ফ্যাটি লিভার
★ কোলন ক্যান্সার
(৫) কিডনি সম্পর্কিত –
★ গ্লোমেরুলোস্ক্লেরোসিস
★ কিডনির ক্যান্সার
(৬) হাড় ও মাংস পেশি সম্পর্কিত –
★ অ্যাঙ্কেল স্প্রেইন বা গোড়ালি মচকানো
★ ফ্ল্যাট ফিট বা পায়ের তলা সমান হয়ে যাওয়া
★ টিবিয়া ভ্যারা বা হাঁটুর নিচের হাড় বাঁকা হয়ে যাওয়া
★ অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা জৈব অবক্ষয় জনিত হাড়জোড়ার প্রদাহজনিত সমস্যা
★ ব্যাক পেইন
(৭) হরমোন জনিত সমস্যা –
★ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স
★ ইমপেয়ারড ফাস্টিং গ্লুকোজ বা খালি পেটে রক্তে সুগারের আধিক্য
★ ডায়াবেটিস
★ যৌন অক্ষমতা
★ অনিয়মিত মাসিক হওয়া
★ পলিসিস্টিক ওভারি
★ হরমোন-সম্পর্কিত ক্যান্সার (স্তন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার)
ডাঃ এম সাঈদুল হক
সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
চীফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা গ্যাস্ট্রো-লিভার সেন্টার।
০১৭০৩-৭২৮৬০১, ০১৭১০-০৩২১৫৮
০১৯২৭-০৬৮১৩৬, ০১৮৬৫-৫০৪০২৬